শাহিদ মোস্তফা শাহিদ,কক্সবাজার সদর :

কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সদস্যের বিরুদ্ধে ঈদগাঁওর প্রাচীনতম ঐতিহাসিক হাঁসের দীঘি দখলের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। জানা যায়, ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে দীর্ঘদিন ধরে এ দীঘিটি ভরাট করে প্লট আকারে বিক্রির জন্য অনেকের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়েছেন বলে জানা গেছে।

সরেজমিন এলাকাবাসীর সাথে কথা হলে জানান, দীর্ঘদিন ধরে দীঘিটি জনস্বার্থে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ওয়াহেদর পাড়ায় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের মুসল্লী ও হেফজ খানার ছাত্ররাও দীঘিটি ব্যবহার করে আসছিল। সম্প্রতি সেচ দিয়ে পানি শুকিয়ে ফেলার কারণে চরম বিপাকে পড়ছে স্থানীয় মুসল্লীরা। যার কারণে ফুঁসে উঠেছে এলাকাবাসী। প্রশাসন কোন ব্যবস্থা না নিলে আগামী জুমাবার এলাকাবাসীকে সাথে নিয়ে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন আন্দোলনের হুশিয়ারী উচ্চারণ করেন স্থানীয়রা।

সমাজতাত্ত্বিক ও পরিবেশবাদীরা জানান, কালের সাক্ষ্যবাহী প্রাচীন ও ঐতিহাসিক দীঘি-পুকুরগুলি একদিকে যেমন আমাদের নৈমিত্তিক জীবনযাত্রার চাহিদা পূরণ করছে তেমনি বাস্তুসংস্থান রক্ষা,দেশীয় মাছের ভান্ডার ও প্রজননক্ষেত্র ,প্রাণীবৈচিত্র্যতা সংরক্ষণ,ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর রক্ষা,বৃষ্টির পানির সংরক্ষণাধার এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছে।

ভূমিরেকর্ড পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ঈদগাঁও’র প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ঐতিহাসিক হাঁসের দীঘি বিগত সার্ধশত বছর (১৫০ বছর) ধরে এতদাঞ্চলের গণমানুষের প্রয়োজন মিটানোর পাশাপাশি, জীববৈচিত্র্যতা সংরক্ষণ,পরিবেশের ভারসাম্যরক্ষা’সহ দেশীয় প্রজাতির মৎস্যের অভয়ারণ্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে।

স্থানীয় ভূমি অফিসসূত্রে জানা যায়, বৃটিশ উপনিবেশিক শাসনামলে তৎকালীন নয়াবাদ মৌজার(বর্তমান ঈদগাঁও, ইসলামাবাদ) আরাকান সড়কের পশ্চিম পাশের ৪ দশমিক ৪০একর জমির উপর জনস্বার্থে ওই হাঁসের দীঘিটি (মৌজা: ঈদগাঁও, আর এস জোত খতিয়ান নং-৯৯২/২৭, এমআরআর খতিয়ান নং-১০২২, আরএস দাগ নং-১৩৫৪, বিএস খতিয়ান নং- ৩১৫১, বিএস দাগ নং-১৯৭৬, জমির শ্রেণী : পুকুর) খনন করা হয়। ওই সময়ের এতদাঞ্চলের প্রশাসনিক প্রেসিডেন্ট হিসেবে তৈয়ব উল্লাহ ফরাজীর উপর হাঁসের দীঘি’সহ সকল সরকারী দীঘি,পুকুর,জলাশয় , জলাধারের সুরক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষনের দায়িত্ব ন্যস্থ হয়। দেশবিভাগের পরবর্তীকালে দীঘিটির মালিকানা পায় বাংলাদেশ সরকার বাহাদুর।  ১৯৬৪-৬৫ সালের ৭৮৫ নং সার্টিফিকেট মামলামূলে ১৭৫ টাকা  নিলামমূল্যে পুকুরশ্রেণী হিসেবে ওই দীঘিটির দখলপ্রাপ্ত মালিক হন তৈয়ব উল্লাহ ফরাজীর ৩পুত্র ১) মমতাজুল হক ২) আবদুল খালেক ৩) আবদুল মালেক।

১৯৯৮সালে ৩৭/৯৮ নং মামলার সোলেনামা মুলে ৪ দশমিক ৪০ একর আয়তনের দীঘিটি পুকুর শ্রেণী হিসেবে সম্পূর্ণভাবে রায়তী মালিকানায় মমতাজুল হকের খাসদখলীয় সম্পত্তি হয়। সেই থেকে ওই দীঘিটি অক্ষতভাবে এঅঞ্চলের ঐতিহ্য, জনস্বার্থ, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে আসছে।

অভিযোগ উঠেছে, মমতাজুল হক ফরাজীর মৃত্যুর পর তাঁর ওয়ারিশ হিসাবে ডাঃ সাইফুদ্দীন ফরাজী কোন প্রকার শ্রেণী পরিবর্তন ব্যতিরেখে দেশের প্রচলিত আইন, জনস্বার্থ, প্রকৃতি ও পরিবেশের তোয়াক্কা না করে দীঘিটি ভরাট ও স্থাপনা নির্মাণ কার্যক্রম শুরু করে। সরেজমিনে দেখা যায়, হাঁসের দীঘির উত্তর অংশ থেকে পুরো দীঘির দুই-তৃতীয়াংশ ইতোমধ্যেই ভরাট করা হয়েছে। ভরাটকৃত জমির উপর কলাগাছ’সহ বিভিন্ন রকমের ফলজ বৃক্ষ রোপন করে আবাদী জমিতে পরিণত করা হয়েছে।

দীঘির বাকী অংশটিও ভরাটের জন্য পানির সেচ করে শুকিয়ে ফেলা হয়েছে। দীঘিটি আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে ধু ধু প্রান্তর। ভরাট ও সামীনা প্রাচীর নির্মাণের জন্য দীঘির পূর্বপাশের পাড় কেটে গাড়ী চলাচলের রাস্তা তৈরী করে মজুদ করা হয়েছে বালি, ইট ও কংক্রীট। ১৬ এপ্রিল দীঘির মাঝখানে পিলার স্থাপন করা হয়েছে। এতদসংক্রান্ত সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।

স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি জানান, দু’দিন ধরে সেখানে সীমানা নির্ধারণের কাজ চালিয়ে আসছিল। ১৭ এপ্রিল দুপুর ৩টার দিকে হঠাৎ শ্রমিকরা চলে যায় বলে কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান।

স্থানীয় জনসাধারণের মতে, দীঘি ভরাটের ফলে ইতোমধ্যেই পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব পডতে শুরু করেছে। হাঁসের দীঘিকে ঘিরে থাকা পাখপাখালীর প্রাত্যাহিক কোলাহল হারিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে প্রাণী বৈচিত্রও। স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল হক জানান, হাঁসের দীঘি বৃহত্তর ঈদগাঁও’র ঐতিহ্যবাহী জলাধার এবং বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় মৎস্যের প্রজননক্ষেত্র।

তিনি আরো বলেন, দীঘি, পুকুর কিংবা জলাধার  ভরাট করা দেশের প্রচলিত আইনের লংঘন। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫(সংশোধিত ২০১০)এর ৬(ঙ) অনুযায়ী জাতীয় অপরিহার্য স্বার্থ ছাড়া কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারী বা আধাসরকারী এমনকি স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পুকুর ভরাট না করার বিধান রয়েছে।

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (২০১০সালে সংশোধিত) অনুযায়ী যেকোন ধরনের জলাধার বা দীঘি বা পুকুর ভরাট করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ এবং ভরাটকারীর বিরুদ্ধে আইনের ৭ ধারায় প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট ও জীববৈচিত্র্য নষ্ট করে পরিবেশগত ক্ষতির জন্য ও বিধ্বংসী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থাগ্রহন করার বিধান রয়েছে।

জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ অনুসারে কোনো পুকুর -জলাশয়,নদী-খাল ইত্যাদি ভরাট করা সম্পূর্ণভাবে বেআইনি।ওই আইনের ৫ধারামতে জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণী পরিবর্তন করা যাবে না বা উক্ত রূপ জায়গার অন্য কোনভাবে ব্যবহার বা অনুরূপ ব্যবহারের জন্য ভাড়া বা ইজারা বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তর করা যাবে না। জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০এর ৮ও১২ ধারা মতে, কোনো ব্যক্তি এই বিধান লংঘন করলে ৫বছরের কারাদ- বা ৫০হাজার টাকার অর্থদ-ে বা উভয় দ-ে দ-নীয় হবেন। বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে অন্তভুক্ত ১৮(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ,জীব বৈচিত্র্য, জলাভুমি,বন ও বন্যপানী সংরক্ষন ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।

হাঁসের দীঘি ভরাট বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর, ককসবাজার এর সহকারী পরিচালক সরদার শরীফুল ইসলাম বলেন, দীঘি ভরাট আইন ও পরিবেশ বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থাগ্রহন করা হবে।

কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান লে:কনের্ল(অব) ফোরকান আহমদ বলেন, দীঘি ভরাট যদি দেশের প্রচলিত আইন বিরুদ্ধ হয় তবে সে যত বড় ক্ষমতাধরই হোক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

হাঁসের দীঘি ভরাট বিষয়ে কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, দেশের পরিবেশ  আইন ও প্রচলিত লংঘন করে কেউ পুকুর-দীঘি কিংবা জলাশয় ভরাট করা হলে ভরাটরোধ ও অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

ঈদগাহ পৌরসভা বাস্তবায়ন আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক ও ব্যবসায়ী নেতা হাসান তারেক বলেন, হাঁসের দীঘি  প্রস্তাবিত ঈদগাহ পৌর এলাকার আওতাভুক্ত একটি প্রাচীন ও ঐতিহাসিক জলাধার। নিলাম মূলে ব্যক্তি মালিকানাধীন হলে এটি মূলত রাষ্ট্রীয়,আমাদের পরিবেশের সম্পদ। ঐতিহ্যের স্বার্থে, পরিবেশের স্বার্থে, জীব বৈচিত্র্য রক্ষার স্বার্থে এবং বৃহৎ জনস্বার্থে এটি সংরক্ষণ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এছাড়া প্রস্তাবিত পৌর এলাকার জলাধার হিসেবে এটি যেকোন ধরনের অগ্নিনির্বাপনে ফায়ার সার্ভিসকে কার্যকর সহযোগিতা দিবে।

তিনি আরো বলেন, ভুমিদস্যুদের দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ না হলে হাঁসের দীঘি রক্ষায় বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। মহানগর, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সকল পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্তস্থান, উদ্যান এবং জলাধার সংরক্ষণ  আইন ২০০০ অনুসারেও পুকুর-দীঘি-জলাধার ভরাট করা আইনের বিরুদ্ধাচরণ।

ওই আইনের ১ অনুচ্ছেদের ২(চ) ধারামতে, প্রাকৃতিক জলাধার অর্থ নদী, খাল, বিল, দীঘি, ঝর্ণা বা জলাশয় হিসাবে মাস্টার প্লানে বা সরকার, স্থানীয় সরকার বা কোন সংস্থা কর্তৃক সরকারী গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা বন্যায় প্রবাহ এলাকা হিসাবে ঘোষিত জায়গা এবং সলল পানি এবং বৃষ্টির পানি ধারণ করে এমন কোন ভুমি ইহার অর্ন্তভুক্ত হইবে।

এ ব্যাপারে কউক সদস্য ডাঃ সাইফুদ্দীনের সাথে মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।